প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও নজরুলের পদচারণ ছিল সাহিত্যের নানা শাখায়।
নজরুল কে আক্ষরিক অর্থে আবিষ্কার করতে বড্ড দেড়ি হয়ে গেছে বোধ করি। তবে, পার্থিব ব্যস্ততার মাঝেও আমার সবসময় মনে হয় একবিংশ শতাব্দীতেও নজরুল কতটা প্রাসঙ্গিক। সবাই নজরুলকে বিদ্রোহী কবি আখ্যা দিলেও, নজরুলের ব্যাপ্তি মানব জীবনের নানান শাখায় বিচরণ করে। আজ ওনার কয়েকটা কবিতার কিছু লাইন শেয়ার করছি।
📖 কবিতা: আমি হবো সকাল বেলার পাখি
হয়নি সকাল–তাই বলে কি সকাল হবে নাকো!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
আমার খুবই প্রিয় দু'টি লাইন, শিশুদের জন্যও এত সাবলীলভাবে এত সুন্দর করে প্রেরণা দেয়া যায়? জাতির তরুণেরা না জাগলে আসলেই উন্নতি সাধণ করা সম্ভব নয়।
📖 কবিতা: নারী
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
~
পুরুষ-হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ।"
আজকের এই সমাজ আসলেই সাম্যের গান গাইতে থাকে কিন্তু তা প্রয়োগ থেকে যোজন যোজন দূরে। নজরুলের কবিতা আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণে নারীর মর্যাদা মনে করিয়ে দেয়। কবি অবলীলায় বলে দিলেন পুরুষ-হৃদয়হীন! কবিতাটি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের মর্যাদা আমাদের বোধগম্য হবে।
📖 কবিতা: ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তোরে মারল' ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা,
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
এই ইসলামিক গানটি আমরা বাঙালীরা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি। মাত্র আধ-ঘন্টায় লেখা এই গানের কথা এবং সুর সবারই মন ছুঁয়ে যায়। অহিংসা ও সাম্যের বাণী সারাজীবন ফেরি করে গেছেন আমাদের নজরুল। ইট মারলে পাটকেল এর বিপরীতে এই সাম্যের বাণী ইসলামিক শিক্ষার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
📖 কবিতা: দাঁড়ালে দুয়ারে মোর
"বুকে তোমায় রাখতে প্রিয়
চোখে আমার বারি ঝরে,
(ওগো) চোখে যদি রাখিতে চাই
বুকে ওঠে ব্যথা ভ'রে। "
প্রণয় নিবেদনের এই শালীনতা আজ আমরা ভুলে গেছি। কবি কথাগুলো খুবই সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এর গভীরতা আর আবেগ যে কোন প্রেমিক-প্রেমিকার মন ছুঁয়ে যাবে। কবি ভেবে পায়না তাঁর প্রেয়সী কে তিঁনি কোথায় রাখবেন। নজরুলের প্রেমের ভাষাও অনবদ্য!
📖 কবিতা: সংকল্প
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।
~
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।
রইব নাকো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।
সংকল্প- ইংরেজীতে এর অর্থ determination/desire/resolution। প্রথম যখন এই শব্দের সাথে পরিচিত হই তখন I was on my cloud nine! বাংলা ভাষাকে এত চমৎকার করার পেছনে নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। কবি সেই যুগেও কতটা সমসাময়ীক চিন্তার মানুষ ছিলেন তা ভেবে আমি বিস্মিত হই। তিঁনি একাধারে বলছেন বিজ্ঞান নিয়ে, কিভাবে মানবজাতি হাউই (রকেট) চড়ে চন্দ্র অভিযানে যেতে চায়। অবাক করার বিষয়, ঠিক পরের লাইনেই "ইঙ্গিত" দিয়ে মঙ্গল গ্রহ থেকে রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি রিসিভ করার কথা বুঝিয়েছেন যা আজকের বিশ্বের রিসার্চ টপিক। স্কুল ড্রপআউট নজরুল সেই যুগেও আমাদের চেয়ে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তা আমার মাথায় খেলেনা। অন্যদিকে তিঁনি বলছেন তখনকার বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে, অল্প কয়েকটি কথায় তুলে ধরেছেন তখনকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট।
শেষ করেছেন মানবজাতিকে উৎসাহ দিয়ে। বদ্ধ খাঁচায় না থেকে বিশ্ব ভ্রমণ এর তাগিদ দিয়েছেন। সংকল্প কবিতাটি আমার ভীষণ প্রিয়, এ কবিতা পড়লে মনে হয় বিশ্ব জয় করে ফেলব। পুরো কবিতাটি পড়ার অনুরোধ রইল।
যাইহোক, নজরুল নিয়ে আমাদের আরো অনেক চর্চা করতে হবে। জাতীয় কবির মর্যাদা তাঁকে যথাযথ ভাবেই দেয়া উচিত। বন্ধুদের আড্ডায় অন্যের দোষ খোঁজাখুজির চেয়ে নজরুলের কয়েকটি লাইন নিয়ে বিশ্লেষণ করা হাজারগুণ শ্রেয়। শুধু "চির উন্নত মম শির" এর গন্ডিতে নজরুলকে আটকে না রাখার অনুরোধ সবার কাছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নজরুলের প্রয়োগ আমাদের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে বলে আশা করি।
হে প্রিয় কবি, শত বছর পরেও আপনার কবিতা বাঙালী জাতির প্রেরণার উৎস। বাংলা সাহিত্যে, বাংলা সংস্কৃতিতে আপনার অবদান অতুলনীয়। আল্লাহ্র দরবারে ফরিয়াদ আপনার ভূল-ত্রুটি মাফ করে দিয়ে আপনাকে জান্নাত দান করুক।